আন্তর্জাতিক

দেউলিয়া হচ্ছে শ্রীলংকা?

প্রকাশ: এপ্রিল ০৭, ২০২২ ১০:২৭ AM
কিছু বড় বড় প্রকল্প শ্রীলংকার জন্য 'শ্বেতহস্তীতে' রূপান্তরিত হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে হাম্বানটোটা সমুদ্রবন্দর ও বিমানবন্দর। গত ১৫ বছর ধরে শ্রীলংকায় সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ তেমন একটি হয়নি। বিদেশি বিনিয়োগের পরিবর্তে বিভিন্ন সরকার ঋণ করার প্রতি মনোযোগী হয়েছে। যা প্রত্যক্ষভাবে আজকের এই অবস্থার জন্য দায়ী। 

চরম এক সংকটকাল অতিক্রম করছে দক্ষিণ এশিয়ার দ্বীপরাষ্ট্র শ্রীলংকা। ১৯৪৮ সালে স্বাধীনতা লাভের পর ইতিহাসের সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক সংকটে পড়েছে এ দেশটি। ইতোমধ্যেই অর্থনৈতিক সংকট মোকাবেলায় সরকারের ব্যর্থতার জের ধরে শ্রীলঙ্কার মন্ত্রিসভার সব সদস্য পদত্যাগ করেছেন। যতই দিন যাচ্ছে খাদ্য, ওষুধ, জ্বালানিসহ অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের অভাব সেখানে প্রকট হয়ে উঠছে। মূলত বৈদেশিক মুদ্রার তীব্র সংকট বেসামাল করে তুলেছে শ্রীলংকার অর্থনীতিকে। পরিস্থিতি এমন অবস্থায় ঠেকেছে যে তারা নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের আমদানি ব্যয়টুকুও মেটাতে পারছে না। ফলে জিনিসপত্রের আকাশছোঁয়া দামে দেশটিতে এখন শুধুই হাহাকার। 

অবস্থা এতোটাই ভয়াবহ যে, কাগজ আমদানি করার মতো বৈদেশিক মুদ্রা না থাকায় সম্প্রতি কাগজের অভাবে দেশটির স্কুল পর্যায়ের পরীক্ষা বাতিল করতে বাধ্য হয়েছে কর্তৃপক্ষ। তাছাড়া জ্বালানী তেলের তীব্র সংকটে তেল সংগ্রহের জন্য লাইনে ভিড় করছে হাজার-হাজার মানুষ । পরিস্থিতি সামাল দিতে পেট্রোল পাম্পগুলোতে সেনাবাহিনী মোতায়েন করেছে দেশটির সরকার।

তবে অতীত ইতিহাসের দিকে চোখ ফেরালে দেখা যায়, একসময় সামাজিক সূচকে শ্রীলঙ্কা ছিল এ অঞ্চলের সবচেয়ে সেরা। শিক্ষায় ছিল সবার তুলনায় এগিয়ে। তাছাড়া পোশাক খাত দক্ষিণ এশিয়ায় প্রথম ঢুকেছিল শ্রীলঙ্কাতেই এবং পর্যটকদেরও পছন্দের জায়গা ছিল শ্রীলঙ্কা। তবে ১৯৮৩ সালে শ্রীলংকায় অন্তর্বর্তী সশস্ত্র সহিংসতা শুরু হলে পিছিয়ে পড়তে থাকে দেশটি। সংখ্যাগরিষ্ঠ সিংহলীদের একটা অংশের মধ্যে বাড়তি জাতীয়তাবাদ মাথা চাড়া দিয়ে ওঠার ক্ষোভে এবং দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে একটি স্বাধীন তামিল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে উত্তরাঞ্চলে হামলা চালিয়ে তামিল বিচ্ছিন্নতাবাদীরা ১৩ জন সেনাকে হত্যা করে। এর প্রতিশোধ হিসেবে সংখ্যাগরিষ্ঠ সিংহলি সম্প্রদায়ের উত্তেজিত জনতা যে পাল্টা হামলা চালায়, তাতে নিহত হন তামিল সম্প্রদায়ের প্রায় তিন হাজার মানুষ। এর পর ২৬ বছর ধরে শ্রীলংকায় গৃহযুদ্ধ চলেছে। নিহত হয়েছেন আশি হাজারের বেশি মানুষ। আর এই গৃহযুদ্ধ শুরু হলে নিরাপত্তার অভাবে পোশাকশিল্প আশির দশকে চলে আসে বাংলাদেশে। উল্লেখযোগ্য হারে কমে যায় পর্যটকদের আসা-যাওয়া। ফলে কিছুটা পিছিয়ে পড়ে অর্থনীতি।  

তবে ২০০৯ সালে গৃহযুদ্ধ সমাপ্তির পরেও শ্রীলঙ্কার মোট দেশজ উৎপাদনের প্রবৃদ্ধি ২০১২ সাল পর্যন্ত ঠিকঠাকই ছিল। সে সময় মাথাপিছু আয় ১ হাজার ৪৩৬ ডলার থেকে বেড়ে হয় ৩ হাজার ৮১৯ ডলার, যা দক্ষিণ এশিয়ায় সর্বোচ্চ। দেশটি ২০১৯ সালে উচ্চমধ্যম আয়ের দেশেও পরিণত হয়েছিল।

বিশ্ব ব্যাঙ্কের বরাত দিয়ে ট্রেডিং ইকোনমিকস নামের ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে,

The Gross Domestic Product per capita in Sri Lanka was last recorded at 4052.75 US dollars in 2020. The GDP per Capita in Sri Lanka is equivalent to 32 percent of the world's average.

অর্থাৎ শ্রীলঙ্কায় মাথাপিছু মোট দেশজ উৎপাদন ২০২০ সালে সর্বশেষ রেকর্ড করা হয়েছিল ৪০৫২.৭৫ মার্কিন ডলার এবং শ্রীলঙ্কায় মাথাপিছু জিডিপি বিশ্বের গড় জিডিপির ৩২ শতাংশের সমান।   

এমনকি ২০১৫ সালে CRI জরিপে দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলে ক্রমবর্ধমান রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিবর্তনে তৎক্ষণাৎ সাড়া দিতে পারে এমন দেশের তালিকায় সেরা দেশ হিসাবে নির্বাচিত হয়েছে শ্রীলংকা।

কিন্তু শেষ পর্যন্ত কোনো অর্জনই ধরে রাখতে পারেনি দেশটি। এককালের ‘জুয়েল অব দ্য ক্রাউন’ নামে খ্যাত সমৃদ্ধ এই দেশ কেন এ রকম সংকটে পড়েছে—এ প্রশ্নের উত্তরে বিশ্লেষকরা ডলার-সংকটের কথা বললেও এই সংকটের গোড়ায় আছে আরও নানাবিধ কারণ।

পরিবারতান্ত্রিক রাজনীতির ধারা

অনেকেই মনে করেন, শ্রীলংকার বর্তমান দুর্দশা অর্থনৈতিক চরিত্রের হলেও নাগরিকদের বিপন্নতার আসল পাটাতন তৈরি করেছে পরিবারতান্ত্রিক রাজনীতি। দেশটির শাসনকাঠামোর গুরুত্বপূর্ণ জায়গাগুলোতে ২০ জনের বেশি আছে শুধু একই পরিবারের। মন্ত্রিসভাতেই আছেন এই ‘রাজাপাকসে’ পরিবারের পাঁচজন —প্রেসিডেন্ট (গোতাবায়া রাজাপাকসে), প্রধানমন্ত্রী (মাহিন্দা রাজাপাকসে), অর্থমন্ত্রী (বাসিল রাজাপাকসে), সেচমন্ত্রী (চামাল রাজাপাকসে) ও যুবমন্ত্রী (নামাল রাজাপাকসে)।

এখানে ক্ষমতাসীন পরিবারের কাছে দেশ পরিচালনা রাজতান্ত্রিক ব্যাপারের মতো। ফলে প্রশাসনিক জবাবদিহি ও আর্থিক শৃঙ্খলার ঘাটতি ছিল দেশে। আর তারই প্রভাব পড়েছে অর্থনীতিতে। তাছাড়া শাসক পরিবারের মনের খেয়ালে নেওয়া অনেক সিদ্ধান্ত এবং বিভিন্ন সময় দেশটির সরকারের নেয়া অনেক অপরিপক্ব সিদ্ধান্তের দায় বর্তমানে শোধ করতে হচ্ছে সমগ্র দেশকে।

তবে গণবিক্ষোভের মুখে অতি সম্প্রতি বর্তমান সরকারের প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসে ও প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপাকসে ছাড়া মন্ত্রিসভার ২৬ সদস্য গত এপ্রিল ৩, ২০২২ তারিখে এক বৈঠকের পর পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন।

বহু অপ্রয়োজনীয় মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন

গত ১৫ বছরে শ্রীলংকা বেশ কিছু মেগা প্রকল্প হাতে নিয়েছে। এর মধ্যে সমুদ্রবন্দর, বিমানবন্দর, রাস্তা এবং আরো নানা ধরণের প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে। এসব প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য বিভিন্ন উৎস থেকে প্রচুর পরিমান ঋণ নিয়েছে শ্রীলংকা । বিপুল অর্থ খরচ করা হলেও অনেক প্রকল্পই অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক হয়নি।

কলম্বো বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক শ্রিমাল আবিরত্নে বিবিসি বাংলাকে বলেন,

কিছু বড় বড় প্রকল্প শ্রীলংকার জন্য 'শ্বেতহস্তীতে' রূপান্তরিত হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে হাম্বানটোটা সমুদ্রবন্দর ও বিমানবন্দর। গত ১৫ বছর ধরে শ্রীলংকায় সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ তেমন একটি হয়নি। বিদেশি বিনিয়োগের পরিবর্তে বিভিন্ন সরকার ঋণ করার প্রতি মনোযোগী হয়েছে। যা প্রত্যক্ষভাবে আজকের এই অবস্থার জন্য দায়ী। 

প্রায় দুই শ মিলিয়ন ডলারে বানানো এখানকার বিমানবন্দরটিতে দিনে মাত্র দুটি বিমান ওঠানামা করতে দেখে ২০১৬ সালে ফোর্বস ম্যাগাজিন তাকে বিশ্বের সবচেয়ে কম ব্যবহৃত বিমানবন্দর উপমা দেয়। ফোর্বসের এই প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয় যে,  

Hardly anybody goes to Sri Lankas Mattala Rajapaksa International Airport (HRI) because they have a flight. No, the air transport hub is currently a daily flight or two away from being completely defunct, and the people who do go there tend to be tourists making a side trip from the nearby wildlife parks to see the stunning, fully modern airport in the middle of the jungle for themselves. অর্থাৎ খুব কমই মানুষ শ্রীলঙ্কার মাত্তালা রাজাপাকসে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে (HRI) ফ্লাইটের কারণে যায়। এয়ার ট্রান্সপোর্টের এই হাবটিতে বর্তমানে দৈনিক একটি বা দুটি ফ্লাইট থাকে। মূলত সম্পূর্ণ আধুনিক এই বিমানবন্দরটি দেখার জন্য কাছাকাছি বন্যপ্রাণী পার্ক থেকে একটি সাইড ট্রিপ করার জন্য পর্যটকরাই জঙ্গলের মধ্যে অবস্থিত এই বিমানবন্দরটি পরিদর্শন করতে বেশি যায়।

তাছাড়া ঋণ মেটাতে সেই হামবানটোটা সমুদ্রবন্দরটিকেও অবশেষে চীনের কাছে সোয়া বিলিয়ন ডলারে লিজ দিতে হয়েছে শ্রীলংকাকে।  

 

বৈদেশিক ঋণের ভার

১৯৯৭ সালে বিশ্বব্যাংক যখন শ্রীলঙ্কাকে নিম্ন আয়ের দেশ থেকে নিম্ন মধ্য আয়ের দেশ হিসেবে স্বীকৃতি দেয় তখন নিম্ন আয়ের দেশ হিসেবে শ্রীলঙ্কা যেসব বৈদেশিক ঋণ পেত তা বন্ধ হয়ে যায়। যার ফলে দেশটিকে ঋণের জন্য নতুন মাধ্যম খোঁজা শুরু করতে হয়। ২০০৭ সালে আন্তর্জাতিক অঙ্গন থেকে ঋণ নেয়ার জন্য দেশটি প্রথমবারের মতো ৫০ কোটি ডলার সমমূল্যের সভ্রেইন বন্ড বা সার্বভৌম বন্ড ইস্যু করে এবং আস্তে আস্তে এই বন্ডের মাধ্যমে ঋণ নেয়ার প্রতি ঝুঁকে পড়ে। এই বন্ডের শর্তগুলো বেশ কঠিন। এই ঋণ শোধ করার জন্য সময় দেয়া হয় ৫ থেকে ১০ বছর, সুদের হার ৬ শতাংশের ওপরে এবং সময়সীমা পার হয়ে গেলে বিনা জরিমানায় ঋণ পরিশোধ করার জন্য এখানে কোনো অতিরিক্ত সময়ও দেয়া হয় না। সবচেয়ে কঠিন শর্ত হলো এই বন্ডের মূল বা আসল টাকা বন্ডের মেয়াদপূর্তির সময় একবারে পরিশোধ করতে হয়। অন্যান্য বন্ডের মতো কয়েক বছর মিলিয়ে শোধ করার সু্যোগ নেই। তাই বন্ডের মেয়াদপূর্তির সময় ঋণগ্রহীতা দেশের উপর বড় ধাক্কা আসে, যা শ্রীলঙ্কার ক্ষেত্রে হয়েছে। ২০২০ এর শেষে এসে দেখা যায় শ্রীলঙ্কার মোট বৈদেশিক ঋণের অর্ধেকই এসেছে এই সভ্রেইন বন্ডের মাধ্যমে।

অর্থনীতিবিদদের ভাষায়, This type of sovereign bond is sold when the expenditure is more than the income of a country. অর্থাৎ একটি দেশের আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি হলে এ ধরণের সার্বভৈৗম বন্ড বিক্রি করা হয়। আন্তর্জাতিক পুঁজিবাজারে এ ধরণের বন্ড বিক্রি করে অর্থের জোগান দেয়া হয় এবং শ্রীলংকা সেটাই করেছে।  কিন্তু এই অর্থ কিভাবে পরিশোধ করা হবে সে ব্যাপারে খুব একটা চিন্তা-ভাবনা করেনি কোন সরকারই। ফলশ্রুতিতে আন্তর্জাতিক সার্বভৈৗম বন্ড বাবদ শ্রীলংকার ঋণ রয়েছে এখন সাড়ে বারো বিলিয়ন মার্কিন ডলার। আর বর্তমানে এই ঋণ শোধ করতে গিয়ে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে টান পড়েছে। যে কারণে দেশটি জ্বালানী তেল এবং অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানি করতে পারছে না। ভারতীয় সংবাদ মাধ্যম ‘দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস’ জানুয়ারি ১৮, ২০২২ তারিখে এ বিষয়ে একটি বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশ করে শিরোনামে লিখেছে- Sri Lanka repays USD 500 million international sovereign bonds amidst economic crisis অর্থাৎ চরম অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যেও শ্রীলঙ্কাকে ৫০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার আন্তর্জাতিক সার্বভৌম বন্ড বাবদ পরিশোধ করতে হয়েছে। 

সব মিলিয়ে শ্রীলঙ্কার ঘাড়ে এখন ৪৫ বিলিয়ন ডলারের ঋণের বোঝা। চলতি বছরের মধ্যে অন্তত ৭ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলারের ঋণ শোধ করতে হবে তাদের। অথচ এ মুহূর্তে দেশটির রিজার্ভ নেমে এসেছে মাত্র ২ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলারে। তাছাড়া শ্রীলঙ্কার বর্তমান দুরবস্থার গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার দাতারাও। যার মধ্যে সবার আগে নাম আসে চীনের। গত দুই দশক তারা কলম্বোয় প্রধান অর্থনৈতিক মিত্র। বিভিন্ন সময় প্রায় চার বিলিয়ন ডলার ঋণ দিয়েছে তারা শ্রীলংকার অবকাঠামো উন্নত করতে। আর সেসব ঋণ এখন দেশটির বিড়ম্বনার একাংশ।

ঋণ দিয়েছে বাংলাদেশও  

গত বছর মার্চে বাংলাদেশ সফরের সময় শ্রীলঙ্কান প্রেসিডেন্ট  মাহিন্দা রাজাপাকসের অনুরোধে চরম সংকটে থাকা দেশটিকে ২৫ কোটি ডলার ঋণ সহায়তা দিয়ে পাশে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয় বাংলাদেশ।  শ্রীলংকাকে ঋণ দেওয়ার মাধ্যমে প্রথম কোনো রাষ্ট্রকে ঋণ দেয় বাংলাদেশ। মুদ্রা বিনিময় প্রথা বা কারেন্সি সোয়াপের নিয়ম মেনে এই ধার দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ সমমূল্যের শ্রীলঙ্কান রুপি দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংকে হিসেবে জমা থাকবে এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন নিয়ে শ্রীলঙ্কা থেকে বাংলাদেশে রফতানিকৃত পণ্যের মূল্য স্থানীয় মুদ্রায় পরিশোধ করবে সেন্ট্রাল ব্যাংক অব শ্রীলঙ্কা। ‘কারেন্সি সোয়াপ’ ব্যবস্থায় নেওয়া ওই ঋণ পরিশোধের কথা ছিল তিন মাসের মধ্যে। লাইবর রেটের (লন্ডন আন্তব্যাংক সুদের হার)  সঙ্গে ২ শতাংশ যোগ করে সুদের হার নির্ধারণ করা হয়েছিল। তবে শ্রীলঙ্কা তা দিতে পারেনি। তাদের অনুরোধে ঋণের মেয়াদ এক বছর বাড়িয়েছিল বাংলাদেশ। সেই সময়েও ডলার ফেরত পাওয়ার আশা বাংলাদেশ ব্যাংক দেখছে না। ফলে সম্প্রতি সময়ে শ্রীলঙ্কা দ্বিতীয়বারের মতো বাংলাদেশের কাছে ঋণ সহায়তা চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংক এই ঋণ সহায়তার আবেদন প্রত্যাখ্যান করেছে।

পর্যটন ও প্রবাসী আয়ে বিপর্যয়

২০১৯ সালের এপ্রিলের ইস্টার বোমা হামলা ও ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে শুরু হওয়া কোভিড-১৯ মহামারি, নিশ্চিতভাবেই এ দুটি ধাক্কা দেশের পর্যটনশিল্পে উল্লেখযোগ্যভাবে পর্যটনপ্রবাহকে হ্রাস করেছে এবং অর্থনৈতিক খাতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। শ্রীলংকায় বৈদেশিক মুদ্রার একটি বড় জোগান আসে দেশটির পর্যটন খাত থেকে। এই খাত থেকে বছরে দেশটির আয় হয় ৪০০ কোটি ডলার। এ অর্থ দেশটির অভ্যন্তরীণ আয়ের মোট অর্থের ২০ থেকে ৩০ শতাংশ। ফলে করোনাভাইরাস মহামারির কারণে প্রায় দুই বছর পর্যটন শিল্পে কর্মকাণ্ড বন্ধ থাকায় এই চরম সংকট সৃষ্টির অন্যতম কারণ। তাছাড়া রাশিয়া-ইউক্রেন সংকটেও পর্যটক আরেক দফা কমেছে। অন্যদিকে দেশটিতে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের আরেকটি বড় জায়গা হচ্ছে বিভিন্ন দেশে কর্মরত শ্রীলংকার নাগরিকদের পাঠনো ডলার। কিন্তু করোনাভাইরাস মহামারির সময় সেটিও বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। 

আকস্মিকভাবে কর কমানো

এছাড়া ২০১৯ সালের নভেম্বর মাসে ক্ষমতায় বসার পর বিস্ময়করভাবে দেশটিতে ভ্যাট এবং ট্যাক্স কমানোর সিদ্ধান্ত নেন প্রেসিডেন্ট গোটাবায়া রাজাপাকসে।

মূলত ২০০৯ সালে শ্রীলংকায় গৃহযুদ্ধ শেষ হবার পরে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট মাহিন্দা রাজাপাকসে এই একই ধরণের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। এর ফলে তখন যুদ্ধ-বিধ্বস্ত অর্থনীতিতে গতি এসেছিল। সে আলোকেই বর্তমান প্রেসিডেন্ট গোটাবায়া রাজাপাকসেও একই পদক্ষেপ নেন।  ভ্যাট প্রদানের হার ১৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে আট শতাংশে আনা হয়। কিন্তু এর কয়েকমাসের মধ্যেই বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাস মহামারি শুরু হয়। ফলে সরকারের রাজস্ব আয় ২৫ শতাংশ পর্যন্ত কমে যায় এবং সরকার আরো ঋণ নিতে বাধ্য হয়। অন্যদিকে সরকারকে আগের ঋণ পরিশোধের বাধ্যবাধকতাও মেনে চলতে হয়। সবমিলিয়ে প্রচন্ড চাপ তৈরি হয় অর্থনীতির উপর। সেসময় এই ভ্যাট-ট্যাক্স কমানোর কারণ ও এর প্রভাব কি হতে পারে তা নিয়ে একটি বিস্তারিত প্রতিবেদন করেছিল সংবাদ মাধ্যম ‘ফাইনানশিয়াল টাইমস’।  Sri Lankas new government poised to slash VAT rate শিরোনাম সংবলিত প্রতিবেদনটিতে তারা আরও উল্লেখ করে যে, Sri Lankas government has announced plans to reduce its Value Added Tax standard rate from 15% to 8% most goods on 1 December 2019. Financial Services will remain at 15%. Tourism-related services will be zero-rated.  At the same time, it will withdraw the 2% Nation Building Tax. অর্থাৎ  শ্রীলঙ্কা সরকার বেশিরভাগ পণ্যের মূল্য সংযোজন করের মান হার ১৫% থেকে কমিয়ে ৮% করার পরিকল্পনা ঘোষণা করেছে, যা কার্যকর হবে ডিসেম্বর ১, ২০১৯ তারিখ থেকে। তবে আর্থিক পরিষেবাগুলিতে ১৫% ই বহাল থাকবে৷ পর্যটন-সংক্রান্ত পরিষেবাগুলোতে কোন ভ্যাট থাকবে না। একইসাথে ২% ন্যাশন বিল্ডিং ট্যাক্সও প্রত্যাহার করা হবে।

অর্গানিক চাষে বিপর্যয়

তাছাড়া বর্তমান প্রেসিডেন্ট ক্ষমতায় বসার পরপরই তার নেয়া তাৎক্ষণিক আরেক সিদ্ধান্ত ছিল কৃষিকে শত ভাগ রাসায়নিক সার ও কীটনাশকমুক্ত করা। এর অংশ হিসেবে শ্রীলংকায় সার আমদানি নিষিদ্ধ করা হয়। কোন ধরণের গবেষণা, পূর্বপ্রস্তুতি এবং বিকল্প না ভেবেই এসব সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।  এতে চালের উৎপাদন ২০ শতাংশ পর্যন্ত কমে যায়। একসময় চাল উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ শ্রীলংকা বাধ্য হয় চাল আমদানি করতে। ফলশ্রুতিতে চালের দাম হু হু করে বাড়তে থাকে। একইসাথে অর্গানিক কৃষির নেতিবাচক প্রভাব পড়ে দেশটির চা উৎপাদনের ক্ষেত্রেও। যে চা রপ্তানি করে শ্রীলংকা প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে, সেখানেও বড় ধাক্কা লাগে।  দেশজুড়ে একই সাথে খাদ্যঘাটতিও প্রকট আকার ধারণ করায় খাদ্যপণ্যের দাম বেড়ে যায় এবং খাদ্য আমদানি করার জন্য আরো বৈদেশিক মুদ্রা খরচ করতে হয় দেশটিকে।

মার্কিন সংবাদ মাধ্যম ‘দ্য নিউইয়র্ক টাইমস’ শ্রীলংকার এই হঠাৎ কৃষি ব্যবস্থা পরিবর্তন ও এর প্রভাব নিয়ে সে সময় একটি বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল। তারা লিখেছিল,

Then came Sri Lanka’s sudden, and disastrous, turn toward organic farming. The government campaign, ostensibly driven by health concerns, lasted only seven months. But farmers and agriculture experts blame the policy for a sharp drop in crop yields and spiraling prices that are worsening the country’s growing economic woes and leading to fears of food shortages. অর্থাৎ তারপরে শ্রীলঙ্কা আকস্মিক এবং বিপর্যয়কর, জৈব চাষের দিকে ঝুঁকে পড়ে এবং এই নিয়ে সরকারের প্রচারনা ও প্রয়োগ মাত্র সাত মাস স্থায়ী হয়েছিল। তবে কৃষক ও কৃষি বিশেষজ্ঞরা এই নীতিকে দায়ী করেছেন ফসলের ফলনের তীব্র হ্রাস এবং দামের ঊর্ধ্বগতির জন্য যা দেশের ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক সমস্যাকে আরও খারাপ করেছে এবং খাদ্য ঘাটতির আশঙ্কার দিকে নিয়ে গিয়েছে।   

তবে বর্তমান এই সংকট থেকে বের হয়ে আসতে শ্রীলংকার প্রয়োজন বৈদেশিক মুদ্রা। সেজন্য বর্তমানে অনেকের দ্বারস্থ হচ্ছে দেশটি। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বা আইএমএফ-এর সাথে আলোচনা করছে দেশটির সরকার। তাছাড়া ইতোমধ্যেই চীন ও ভারতের কাছে আরো ঋণের আবেদনও করেছে তারা। তবে ঋণের এই স্তুপ থেকে বেরিয়ে আসতে দেশটির দরকার দীর্ঘমেয়াদী পদক্ষেপ। আর দীর্ঘমেয়াদী পদক্ষেপের প্রথম ধাপ হিসেবে দেশটির রপ্তানি বাড়াতে হবে। অন্যদিকে রপ্তানি বাড়াতে হলে পণ্যের বৈচিত্র্য আনা দরকার। আর এজন্য প্রয়োজন বৈদেশিক বিনিয়োগ। ফলে খুবই দৃঢ় এবং পরিকল্পিত পদক্ষেপেও এই সংকট উত্তরণে দেশটির কয়েক বছর লেগে যেতে পারে।  

মন্তব্য (0)


দুঃখিত ! কোন মন্তব্য পাওয়া যায়নি

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন

সত্যিই কি সৌদি আরবে মসজিদে লাউডস্পিকার নিষিদ্ধ করা হয়েছে?
মার্চ ২৬, ২০২৩ ০৭:১৯ AM
আর্জেন্টিনা যেতে সত্যিই কোন ভিসার প্রয়োজন নেই?
মার্চ ০৯, ২০২৩ ০১:২৩ PM
ফাটল ধরা পিলারের ছবিটি বাংলাদেশের নয়
মার্চ ০২, ২০২৩ ১১:১১ AM
চীন-তাজিকিস্তান সীমান্তে সাম্প্রতিক ভূমিকম্পের দাবিতে পুরোনো ভিডিও ভাইরাল
ফেব্রুয়ারী ২৮, ২০২৩ ১২:১৭ PM
তুরস্কের অভিনেতা বুরাক ওজচিভিতের ভিডিওটি ভূমিকম্প উদ্ধারকার্যের নয়
ফেব্রুয়ারী ১৪, ২০২৩ ১২:১০ PM
টিভি সিরিজের অভিনয় দৃশ্যকে তুরস্ক ভূমিকম্পের ছবি দাবিতে প্রচার
ফেব্রুয়ারী ১২, ২০২৩ ১২:৩২ PM
মক্কায় তুষারপাতের ঘটনা কি সত্য?
জানুয়ারী ১৪, ২০২৩ ১১:২৩ AM
বিশ্বকাপ ফাইনালে মেসিকে পরিয়ে দেয়া বিস্তটি বগুড়ায় তৈরি?
ডিসেম্বর ২২, ২০২২ ১২:৪৭ PM