তথ্য প্রযুক্তি

সাইবার বুলিংঃ সুরক্ষিত থাকা ও প্রতিরোধের উপায়

প্রকাশ: মার্চ ২৭, ২০২২ ০৭:৫১ AM

প্রযুক্তির ছোঁয়ায় ইন্টারনেট এখন মানুষের হাতের মুঠোয়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এখন কমবেশি সবার বিচরণ, শহর থেকে শুরু করে প্রত্যন্ত অঞ্চল, সবখানেই এখন ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের জয়জয়কার। আর সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়ে চলেছে সাইবার ক্রাইমের মাত্রা এবং মারাত্মক আকার ধারণ করেছে সাইবার বুলিং। এক বেদনাদায়ক আতঙ্ক ও অস্থিরতার নাম হচ্ছে এখন সাইবার বুলিং। এজন্য টিম চেক ফ্যাক্ট চেষ্টা করেছে সাইবার বুলিং কি ও সাইবার বুলিং এর শিকার হলে করণীয় এবং প্রতিকার নিয়ে আপনাদের কিছুটা জানানোর। আসুন জেনে নেই সাইবার বুলিং সম্পর্কে বিস্তারিত।


সাইবার বুলিং কি

সাইবার বুলিং বা ভার্চুয়াল হয়রানি একটি আক্রমণাত্মক এবং ইচ্ছাকৃত কাজ যা বারবার সম্পাদিত হয়, কোনও গোষ্ঠী বা কোনও ব্যক্তির দ্বারা। মূলত ভার্চুয়াল এই দুনিয়ায় খুব সহজেই চাইলে নিজের পরিচয় গোপন রাখা যায়। যার জন্য প্রতিনিয়িত সাইবার বুলিং এর শিকার হচ্ছে সমাজের বিভিন্ন মহলের ব্যক্তিরা।

সাধারণত যেসব প্লাটফর্মে সবচেয়ে বেশি সাইবার বুলিং হয়:


  • সোশ্যাল মিডিয়া, যেমন Facebook, Instagram, Snapchat, এবং Tik Tok
  • মোবাইল বা ডিভাইসে টেক্সট মেসেজিং এবং মেসেজিং অ্যাপ
  • তাৎক্ষণিক বার্তাপ্রেরণ, সরাসরি বার্তাপ্রেরণ, এবং ইন্টারনেটে অনলাইন চ্যাটিং
  • অনলাইন ফোরাম, চ্যাট রুম এবং মেসেজ বোর্ড, যেমন Reddit ইমেইল

*অনলাইন গেমিং কমিউনিটি

 দেশে সাইবার বুলিং এর পরিসংখ্যান

বাংলাদশে সাইবার বুলিং সবথেকে বেশি আক্রমণের শিকার হচ্ছে নারীরা। ইংরেজী জাতীয় দৈনিক ডেইলি স্টার এর এক প্রতিবেদনে বলা হয় বাংলাদেশের শতকরা ৮০ শতাংশ নারী বিভিন্ন সময় আনলাইনে সাইবার বুলিং এর শিকার হচ্ছেন। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার ৫১ শতাংশ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে। এর মধ্যে ৬০ শতাংশই কোনো না কোনোভাবে নিয়মিত সাইবার বুলিং, আপত্তিকর মন্তব্য কিংবা হয়রানির শিকার হয়।



এছাড়া ইউনিসেফের ২০১৯ সালের এক জরিপ অনুযায়ী, দেশে সাইবার বুলিংয়ের শিকার হওয়া ৩৮ শতাংশ মানুষের বয়স ১০ থেকে ১৩ বছর; ৩৬ শতাংশের বয়স ১৪ থেকে ১৫ বছর এবং ২৫ শতাংশের বয়স ১৬ থেকে ১৭ বছর। ঢাকায় অনলাইনে হয়রানির শিকার নারীদের ৭০ শতাংশের বয়স ১৫ থেকে ২৫ বছরের মধ্যে। 

বাংলাদেশসহ এশিয়ার কয়েকটি দেশের ওপর চালানো এক জরিপের বরাত দিয়ে ২০১৭ সালে বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়-এসব দেশে সাইবার বুলিংয়ের ঝুঁকি উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে এবং নারী ও অপ্রাপ্তবয়স্ক কিশোরীরা সবচেয়ে বেশি শিকার হচ্ছে বুলিংয়ের।


সাইবার বুলিং এর ভয়াবহতা

 

অনলাইনে হয়রানি বা সাইবার বুলিংয়ের কারণে অনেকেই হতাশায় ভোগে। তাদের একটি অংশ হতাশা সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। এরকম দুটি উদাহরণ তুলে ধরতে চাই।

জাপানের ২২ বছর বয়সি হানা কিমুরা একজন পেশাদার কুস্তিগির ছিলেন। এছাড়া নেটফ্লিক্সের জনপ্রিয় রিয়েলিটি টিভি শো ‘টেরাস হাউসে’ অভিনয় করেছেন তিনি। গত বছরের ২৩ মে আত্মহত্যা করেন কিমুরা। অনলাইনে টেরাস হাউসের দর্শকদের ক্রমাগত সমালোচনার প্রতিক্রিয়ায় আত্মহত্যা করার আগে বেশ কয়েকটি টুইট করেছিলেন তিনি। কিমুরার টুইটগুলোতে আত্মহত্যার আভাস ছিল।

দক্ষিণ কোরিয়ার ২৫ বছর বয়সি সল্লি একজন অভিনেত্রী, গায়িকা ও মডেল ছিলেন। মেয়েদের বিখ্যাত কে-পপ ব্যান্ড ‘এফ (এক্স)’-এর সদস্য ছিলেন তিনি। তবে তার আরেক পরিচয় তিনি ‘নো-ব্রা’ আন্দোলনের একজন সমর্থক ছিলেন। অর্থাৎ, মেয়েদের বক্ষবন্ধনী না পরার পক্ষে ছিলেন সল্লি। এ জন্য তাকে সাইবার বুলিংয়ের শিকার হতে হয়েছে। এ কারণে হতাশায় ভুগে ২০১৯ সালে আত্মহত্যা করেন তিনি।

সাইবার বুলিং: প্রতিরোধ এবং সচেতনতা


২০১২ সালের ১৭ জুন সাইবার বুলিংয়ের বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে প্রথম ‘Stop Cyberbullying Day’ উদযাপন করা হয়। এরপর থেকে প্রতি বছরের জুন মাসের তৃতীয় শুক্রবার দিবসটি উদযাপন করা হচ্ছে।


ইন্টারনেটের দুনিয়ায় প্রতিনিয়ত যেমন বাড়ছে সম্ভাবনা তেমনই এর ভুল ব্যবহারে তৈরি হচ্ছে নানা ধরনের অনিরাপত্তা। কিন্তু একটু সতর্ক হলেই নিরাপদ থাকা সম্ভব। তাই ইন্টারনেটের সঠিক ব্যবহার সম্পর্কে জানতে হবে ও বুঝতে হবে কোথায় আমাদের থামতে হবে।


ফেক প্রোফাইল সতর্কতা

 

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারের সময় একটু সতর্ক হলেই অনলাইন এক্সপেরিয়েন্স আরও নিরাপদ করে তোলা সম্ভব। সোশ্যাল মিডিয়ায় আমরা নিশ্চয়ই কোনো না কোনো পরিচয়ে পরিচিত। যাকে প্রোফাইল বলে থাকি। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে যখন কেউ নিজের পরিচয় গোপন করে ভিন্ন নাম বা ছবির আড়ালে। এসব ফেক প্রোফাইল হতে পারে আপনার জন্য ক্ষতির কারণ। ফলে এ সম্পর্কে আমাদের যেমন জানতে হবে তেমনই নিরাপদও থাকতে হবে।



ফেক প্রোফাইল চিনবেন কীভাবে

 

প্রথমেই প্রোফাইলের ছবি চেক করুন। ছবিটি সার্চ দিয়ে দেখতে পারেন অন্য কোথাও পাওয়া যায় কি না। তাছাড়া চেক করে দেখতে হবে- ইউজার নেম ও আইডি নেম একই কি না। এমন প্রোফাইলের ফ্রেন্ডলিস্টেও অন্য সন্দেহজনক আইডি যুক্ত আছে কি না। অ্যাবাউট সেকশন থেকে বেসিক ইনফো চেক করে নিন।


সেলিব্রেটি কিংবা গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের আসল আইডি চেনার সহজ উপায় ভেরিফাইড মার্ক চেক করা। ফেক আইডি সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে গেলে তাকে আনফলো বা আনফ্রেন্ড করে দিতে পারেন। ফেক আইডিটি বন্ধ করার জন্য সেই প্রোফাইলে গিয়ে রিপোর্টও করতে পারেন। আর যদি এসব আইডি থেকে কোনো রকম হয়রানির শিকার হন তবে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কাছে অভিযোগও জানাতে পারেন।



গুজব এড়িয়ে চলা

 

জেনে বা না জেনে অনালাইনে আপনার ছোট্ট একটি শেয়ার হতে পারে অনেক বড় ক্ষতির কারণ। ইন্টারনেট ব্যবহারে একটু দায়িত্বশীল আচরণের মাধ্যমেই গুজব প্রতিরোধ করা সম্ভব। কিন্তু প্রতিদিন এতসব ইনফরমেশনের ভিড়ে কোনটি সঠিক কোনটি ভুল বুঝবেন কীভাবে? এজন্য প্রথমেই তথ্যটির সোর্স খেয়াল করতে হবে। যে সোর্স থেকে তথ্যটি এসেছে তা বিশ্বাসযোগ্য কি না যাচাই করে দেখুন। এছাড়াও খেয়াল করে দেখতে হবে- সংবাদটি অন্য কোনো নির্ভরযোগ্য সাইটে প্রকাশিত হয়েছে কি না। ওয়েব অ্যাড্রেসটি অদ্ভুত লাগছে কি না। যে প্রতিষ্ঠান বা সংস্থা খবরটি দিয়েছেন তার নাম কোথাও শুনেছেন কি না।

 

এই বিষয়গুলো যাচাই করার পর যদি মনে হয় ইনফরমেশনটি ভুল তবে অবশ্যই শেয়ার করা থেকে বিরত থাকতে হবে। যদি কোনো পেজ থেকে তথ্যটি আপনার সামনে আসে তবে রিপোর্ট করে দিতে পারেন আর ই-মেইলের ক্ষেত্রে রিপোর্ট করুন স্প্যাম মেইল হিসেবে।



অনলাইন হ্যারাসমেন্ট প্রতিরোধ

কথায় আঘাত লাগে! অনলাইনে অন্যের ব্যবহার করা ছোট্ট একটি শব্দ কিংবা ইমোজির এক্সপ্রেশন হয়ে উঠতে পারে অস্বস্তির কারণ। তবে ইন্টারনেট ব্যবহারে একটু সচেতন হলেই এমন পরিস্থিতি এড়িয়ে চলা সম্ভব। আপনার ফ্রেন্ডলিস্টে নিশ্চয়ই এমন কেউ আছেন যাকে আপনি চেনেন না। এমন সব অচেনা মানুষ কখনও আপনার ক্ষতির কারণ হতেই পারে। তাই অপরিচিত কারো ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট একসেপ্ট করা থেকে বিরত থাকতে হবে। শুধু তাই নয় বরং- সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্যক্তিগত ইনফো পাবলিক করে রাখবেন না। সন্দেহজনক লিংকে ক্লিক করা থেকে বিরত থাকতে হবে। অপরিচিত মেইল বা মেসেজ এড়িয়ে চলতে হবে। অন্য কারো পোস্টে আপনাকে ট্যাগ করার অপশন বন্ধ করে রাখতে পারেন। ইন্টারনেটের দুনিয়ায় সম্ভাবনা যেমন সীমাহীন তেমনি এর ভুল ব্যবহারে হতে পারে ক্ষতি। সচেতন হলেই নিরাপদ থাকা সম্ভব।


ব্যক্তিগত তথ্যের সুরক্ষা

 

  • রিয়েল লাইফে আপনার একান্ত ব্যক্তিগত তথ্য কি সবার সাথে শেয়ার করেন? তাহলে অনলাইনে কেনো? ইন্টারনেটের দুনিয়ায় শেয়ার করা আপনার পার্সোনাল ইনফরমেশন অনেক ক্ষেত্রে আপনার জন্যই ক্ষতির কারণ হয়ে উঠতে পারে।



  • অনলাইনে নিজের পুরো নাম, ফোন নম্বর, ই-মেইল আইডি কিংবা পাসওয়ার্ড শেয়ার করা থেকে বিরত থাকতে হবে। এছাড়া নিরাপদ থাকতে শক্তিশালী পাসওয়ার্ড ব্যবহার করতে হবে। লোকেশন সেটিং বন্ধ রাখার মাধ্যমে নিজের অবস্থান না জানানোই ভালো।

 

  • আপনার পোস্ট কারা দেখতে পারবে সেটি ঠিক করে দিতে পারেন। টু-স্টেপ ভেরিফিকেশন চালু রাখতে হবে। ই-মেইল আইডি বা ফোন নম্বর দিয়ে কেউ খোঁজার চেষ্টা করলে পাবে কি না সেটি ঠিক করে দিতে হবে।


প্রতিনিয়ত নতুন নতুন উপায়ে আপনার শেয়ার করা ব্যক্তিগত তথ্যের ভুল ব্যবহার হতে পারে। সুতরাং, অনলাইন নিরাপত্তা সম্পর্কে জানতে হবে এবং ব্যক্তিগত তথ্য শেয়ার করার বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে।

 

 

 

 

 

আইনি সহায়তাঃ


সাইবার বুলিং এর শিকার হলে প্রথম কাজ হচ্ছে থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করা। তবে পরিবারের সদস্যদের সহযোগিতা নিয়ে যাওয়াটা অবশ্যই উচিত। সঙ্গে রাখতে হবে হয়রানির প্রমাণও। স্ক্রিন শট কিংবা মেসেজ।


এছাড়া হয়রানির শিকার যে কেউ এখন ৯৯৯ অথবা পুলিশের ফেসবুকে পেজে নক করলেও সহায়তা পাবেন। এ ছাড়া মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের হটলাইন ১০৯২১ নম্বরে গোপনীয়তা রক্ষা করে এ ধরণের সমস্যার সমাধান করা হয়। সরাসরি বিটিআরসি’র ফোনে ও ই-মেইলেও অভিযোগ করা যায়। বিড়ম্বনার শিকার যে অনলাইন জগতে সেই জগতেই এর সুরাহা সন্ধানেরও পথের দিশা পাওয়া যাবে।

 

মন্তব্য (0)


দুঃখিত ! কোন মন্তব্য পাওয়া যায়নি

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন

নকল নিউজকার্ডে চিত্রনায়িকা পূর্ণিমার নামে ভুয়া তথ্য
ডিসেম্বর ১২, ২০২৩ ১১:০৪ AM
গণমাধ্যমের সংবাদ বিকৃত করে বাসে আগুন দেওয়ার ঘটনায় ছাত্রলীগ কর্মী আটকের গুজব
নভেম্বর ১৮, ২০২৩ ১১:৫৯ AM
মেসির হাতে ফিলিস্তিনের ছবি দাবিতে বিকৃত ছবি প্রচার
নভেম্বর ১৮, ২০২৩ ১১:১৮ AM
বিএনপি নেতা ইশরাক হোসেনকে গ্রেপ্তারের গুজব
নভেম্বর ১১, ২০২৩ ১০:২৬ AM
প্রধানমন্ত্রীকে হত্যার হুমকিদাতাকে গ্রেফতার দাবিতে ভাইরাল ছবিটি পুরোনো!
মে ২২, ২০২৩ ১১:২৯ AM
ফেসবুক ব্যবহার করতে মাসে ১২০০ টাকা ফি দেয়ার দাবিটি বিভ্রান্তিকর
ফেব্রুয়ারী ২৬, ২০২৩ ১২:৩৮ PM
খসড়া নীতিমালায় নেই ‘আজ আমার মন খারাপ’ প্রসঙ্গ!
এপ্রিল ১৮, ২০২২ ০৫:২৪ AM
বাংলাদেশ সরকার পরিচালিত সেবা নম্বর ও সুবিধাসমূহ
মার্চ ২৮, ২০২২ ০৫:৫১ AM