চিকিৎসা ও স্বাস্থ্য

আঙুল ও কানে রক্তপাত ঘটিয়ে সত্যিই স্ট্রোক প্রতিরোধ সম্ভব?

প্রকাশ: এপ্রিল ২৮, ২০২২ ০৮:২৮ AM

 “ইস! কৌশলটা আগে জানা থাকলে হয়তো বাবা স্ট্রোক করে মারা যেতেন না!” এই শিরোনামে সম্প্রতি একটি প্রতিবেদন ফেসবুকে ব্যাপকভাবে ভাইরাল হয়েছে। প্রতিবেদনটিতে স্ট্রোক প্রতিরোধে সুচ ফুটিয়ে আঙুল ও কানে সময়মত রক্তক্ষরণ করানোর কথা উল্লেখ করা হয়। এই তথ্যের সত্যতা যাচাই এবং বিস্তারিত জানতে টিম চেক ফ্যাক্ট অনুসন্ধানে নামে। আসুন দেখে নেয়া যাক অনুসন্ধানে কি পেলাম আমরা।  

ভাইরাল তথ্যঃ

ইস! কৌশলটা আগে জানা থাকলে হয়তো বাবা স্ট্রোক করে মারা যেতেন না!” শিরোনামের এই খবরটি বেশ কয়েক বছরের পুরোনো হলেও কিছুদিন  পর পর এই খবরটিকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে দিতে দেখা যায়। সাম্প্রতিক সময়েও এই খবরটি বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পরেছে। বার্তাটিতে বলা হয়েছে যে, যদি কেউ স্ট্রোক করতে পারে বলে বোঝা যায়, তাহলে তৎক্ষণাৎ সেই ব্যাক্তির হাতের ১০ আঙুলের প্রতিটির মাথায় একটি সূচ গরম করে ক্ষত সৃষ্টি করে রক্তক্ষরণ করাতে হবে। একইসাথে স্ট্রোকে আক্রান্ত ব্যাক্তির মুখ বিকৃতি প্রতিরোধে আক্রান্ত ব্যাক্তির দুই কান থেকে কমপক্ষে দুই ফোটা রক্তক্ষরণের জন্য সূচ দিয়ে কানের নরম অংশে ক্ষত সৃষ্টি করার কথাও বলা হয়েছে। তাছাড়া এই রক্তক্ষয় পদ্ধতি চীনে প্রথাগত ভাবে চিকিৎসার অংশ হিসেবে ব্যবহার হয়ে আসছে বলেও এই পোস্টটিতে উল্লেখ করা হয়েছে।  

Bangla News Finder নামের একটি অনলাইন নিউজ পোর্টালের ফেসবুক পেজ থেকে “ইস! কৌশলটা আগে জানা থাকলে হয়তো বাবা স্ট্রোক করে মারা যেতেন না!” শিরোনামেই বার্তাটির একটি লিংক শেয়ার করা হয়েছে। স্ক্রিনশটে দেখা যাচ্ছে পোস্টটিতে ২১৩টি রিয়াক্ট ও ৪ টি  কমেন্ট করা হয়েছে এবং পোস্টটি ৫৩ বার শেয়ার করা হয়েছে।

এছাড়া Durbinbd24 নামক আরেকটি অনলাইন নিউজ পোর্টালের ফেসবুক পেজ থেকেও একই শিরোনামে বার্তাটির লিংক শেয়ার করা হয়েছে। পোস্টটি ১৬ বার শেয়ার করা হয়েছে বলেও দেখা যায়।

চেক ফ্যাক্ট অনুসন্ধান-

চেক ফ্যাক্ট পুরো ঘটনাটি তথ্য উপাত্তের মাধ্যমে বিশ্লেষণ করে দেখার চেষ্টা করেছে।  

অনুসন্ধানের প্রথম ধাপ হিসেবে কী-ওয়ার্ড সার্চ করা হলে ‘The Claim: Pricking a Stroke Victims Fingers Can Help delay symptoms শিরোনামে The New York Times এর একটি প্রতিবেদন সামনে আসে। যেখানে Duke Stroke Centre এর ডিরেক্টর Dr. Larry B. Goldstein এর বরাত দিয়ে বলা হয়েছে-

Forcing a stroke victim to sit up is never a good idea, because it can cause a drop in blood pressure. It would be better to help the person lie down. Pricking the victim’s finger is also a bad idea, not only because it is futile, but because doing so can delay medical treatment, which is the only thing that can help.

THE BOTTOM LINE Only emergency medical treatment can help a stroke victim.  

 

অর্থাৎ একজন স্ট্রোকের শিকার ব্যক্তিকে জোর করে উঠিয়ে বসানো কখনই ঠিক নয়, কারণ এটি রক্তচাপ হ্রাসের কারণ হতে পারে। বরং আক্রান্ত ব্যক্তিকে শুইয়ে দেয়া ভাল। তাছাড়া আক্রান্ত ব্যক্তির আঙুলে কোন ধরণের ক্ষত তৈরিও নিরর্থক। এটি কেবল আক্রান্তের দ্রুত চিকিৎসা শুরুর সময়কে বিলম্বিত করবে।  

এক্ষেত্রে শেষ কথা হচ্ছে, শুধুমাত্র জরুরী চিকিৎসাই একজন স্ট্রোকের শিকার ব্যক্তিকে সাহায্য করতে পারে

 

তাছাড়া কী-ওয়ার্ড সার্চের মাধ্যমে Mayo Clinic নামে আমেরিকান একটি অলাভজনক একাডেমিক চিকিৎসা কেন্দ্রের ওয়েবসাইটের লিঙ্কও নজরে আসে। যেখানে বলা আছে-

‘A stroke is a true emergency. The sooner treatment is given, the more likely it is that damage can be minimized. Every moment counts.’  

অর্থাৎ স্ট্রোক একটি মারাত্মক শারীরিক অবস্থা। যত তাড়াতাড়ি চিকিৎসা দেওয়া হবে, ক্ষতির সম্ভাবনা তত কম। এক্ষেত্রে প্রতিটি মুহূর্ত গুরুত্বপূর্ণ।

এছাড়া ওয়েবসাইটটিতে স্ট্রোকের প্রধান উপসর্গগুলো কথা উল্লেখ করে আরও বলা আছে যে, একিউট বা মেজর স্ট্রোক অথবা মাইনর স্ট্রোক কোন ধরনের স্ট্রোকই কেবল উপসর্গ দেখে যথাযথ পরীক্ষা নিরীক্ষা ছাড়া নির্ণয় করা সম্ভব না। যেহেতু সব স্ট্রোকেরই লক্ষণগুলো প্রায় একই এবং ভিন্ন শারীরিক সমস্যায়ও এইসব দেখা দিতে পারে, তাই স্ট্রোক হচ্ছে কিংবা হয়েছে মনে হলে খুব দ্রুত ডাক্তারের পরামর্শ গ্রহণ করা একান্ত জরুরি।  

স্ট্রোক কিঃ

স্ট্রোক হল মস্তিষ্কের রক্তনালির একটি রোগ। সেই রক্তনালি ছিঁড়ে যাওয়া অথবা ব্লক হয়ে যাওয়া স্ট্রোকের কারণ। অতএব স্ট্রোক দু’ধরনের-

১. রক্তনালি ছিঁড়ে গিয়ে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ। একে বলে হেমোরেজিক স্ট্রোক।

২. রক্তনালি ব্লক হয়ে গিয়ে মস্তিষ্কে পর্যাপ্ত রক্ত না যাওয়া এবং ওই অংশের শুকিয়ে যাওয়া। একে বলে ইস্কেমিক স্ট্রোক।

কেন স্ট্রোক হয়ঃ

সাধারণত কিছু ক্ষেত্রে অনেকদিন ধরে ধীরে ধীরে বাড়ে স্ট্রোকের ঝুঁকি। অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস, হাই-প্রেসার, হাই-কোলেস্টেরল, ধূমপান, পারিবারিক স্ট্রোকের ইতিহাস, হার্টের অসুখ যেমন- অনিয়মিত হৃদস্পন্দন, রক্তজমাট বাঁধা অসুখ, ক্যান্সার ইত্যাদি আরও অনেক কারণ রয়েছে স্ট্রোকের।  আবার অনেক সময় কোনো পূর্ব রোগ ছাড়াও হঠাৎ করেই হতে পারে স্ট্রোক। এক্ষেত্রে হঠাৎ উত্তেজিত হওয়া, জন্মগত রক্তনালির গঠনগত সমস্যা, জন্মগত এনজাইমের সমস্যা, মেটাবলিক সমস্যা ইত্যাদি রয়েছে।  তাই শুধু বয়স্কদের নয়, একেবারে তরুণদের মধ্যেও স্ট্রোক হতে দেখা যায়।

স্ট্রোকের লক্ষণঃ

সবসময় সবধরনের স্ট্রোকের একই রকম লক্ষণ হয় না। কী ধরনের স্ট্রোক, কী কারণে হল, মস্তিষ্কের কোন অংশে হল তার ওপর ভিত্তি করে লক্ষণও হতে পারে ভিন্ন। হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে পড়ে যাওয়ায়ও যেমন স্ট্রোক হতে পারে, তেমনই শরীরের কোনো অংশ ধীরে ধীরে দুর্বল বা অবশ হয়ে যাওয়া, ভারসাম্য হারিয়ে পড়ে যাওয়া, মুখ একদিকে বাঁকিয়ে যাওয়া, মুখ থেকে খাবার ও পানি গড়িয়ে পড়া, কথা জড়িয়ে যাওয়া, আচরণে অস্বাভাবিক পরিবর্তন যেমন- চিনতে না পারা, অপ্রাসঙ্গিক বা আজেবাজে কথা বলা, অকারণে বিরক্ত হয়ে হইচই করা, একদম চুপচাপ হয়ে যাওয়া ইত্যাদি। এগুলো হওয়া মানেই যে স্ট্রোক- এমনটি নয়। আরও অনেক কারণেই এমন হতে পারে। তবে এ ধরনের কোনো লক্ষণ দেখা দিলে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।

স্ট্রোক হলে কী করণীয়ঃ

পরিবারের কারো এ ধরনের লক্ষণ দেখা দিলে অবশ্যই ভয় ও উদ্বিগ্ন লাগাটা স্বাভাবিক। এক্ষেত্রে আপনার প্রথম ও প্রধান করণীয় রোগীকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে যত দ্রুত সম্ভব অ্যাম্বুলেন্স ডাকা এবং হাসপাতালে নেয়ার ব্যবস্থা করা। কোনো ধরনের ওষুধপত্র নিজ থেকে দিবেন না। কারণ স্ট্রোকটি হেমোরেজিক না ইস্কেমিক আপনি জানেন না, ওষুধ প্রদানে উল্টা তার ক্ষতি হতে পারে। মুখে কিছু খাওয়াতে যাবেন না, এমনকি পানিও। এ খাবার ও পানি তার শ্বাসনালিতে গিয়ে আটকে যেতে পারে ও শ্বাসকষ্ট হতে পারে অথবা ইনফেকশন করতে পারে, যা এ অবস্থায় তার জন্য খুবই ক্ষতিকর।

আর ওই যে ভাইরাল পোস্টে পড়েছেন সুই দিয়ে আঙ্গুল ফুটো করে দেয়া- সেটি ভুলেও করবেন না। এতে রক্তক্ষরণ থেকে রোগী আরও খারাপ হয়ে যেতে পারে, ক্ষতের জায়গায় ইনফেকশন হয়ে রক্তে ছড়িয়ে সেপটিসেমিয়া হয়ে যেতে পারে এবং আমাদের শরীরের ডিফেন্স মেকানিজমে রক্তনালি সংকুচিত হয়ে স্ট্রোকের ফলাফল আরও খারাপ হতে পারে। স্ট্রোকের চিকিৎসায় যেই হাড় ছিদ্র করে বারহোল সার্জারির কথা বলা হয়েছে, অনেকে এর সঙ্গে হাতে সুই ফোটানোকে গুলিয়ে ফেলেছে। বারহোল করে মস্তিষ্কের জমাটরক্ত সরানো হয়, যা মস্তিষ্কের একটি অংশে চাপ দিচ্ছে। হাত, পা, কান ফুটো করে কয়েক লিটার রক্ত বের করেও এ জমাটরক্ত কমানোর কোনো পথ নেই। যদি বের করতেই হয় তবে মাথার হাড়ই ফুটো করতে হবে এবং এ ডিসিশন একমাত্র আপনার চিকিৎসকই দিতে পারেন।

উপরোক্ত তথ্য প্রমাণের ভিত্তিতে বলা যায়, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বহুল প্রচারিত এই বার্তাটি সত্য নয়।  তাই অনলাইনে পাওয়া যে কোন তথ্য বিশেষত, স্বাস্থ্য ও খাদ্য বিষয়ক তথ্যগুলো নির্ভরযোগ্য উৎস ছাড়া বিশ্বাস করা থেকে বিরত থাকুন। প্রয়োজনে ডাক্তারের পরামর্শ নিন এবং এরূপ তথ্য শেয়ারের পূর্বে সম্পূর্ণ নিশ্চিত হয়ে নিন।      

 

 

 

 

মন্তব্য (0)


দুঃখিত ! কোন মন্তব্য পাওয়া যায়নি

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন

সত্যিই কী লেবুর রস মিশ্রিত গরম পানি সেবনে ক্যান্সার নিরাময় হয়?
সেপ্টেম্বর ০৫, ২০২২ ০৫:০২ PM
ঋতুস্রাবকালীন কিছু খাবার এবং নিয়ম মেনে চলা নিয়ে ফেসবুকে ভাইরাল পোস্টের দাবিগুলো মিথ্যা
জুলাই ২০, ২০২২ ০৮:৩১ AM
মাংকিপক্সঃ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের গুজব
মে ৩১, ২০২২ ০৮:১২ AM
চট্টগ্রামে একসাথে সাত সন্তান জন্মদানের দাবিটি সত্য নয়
মে ২৯, ২০২২ ০৮:১৪ AM
মেয়েদের সতীচ্ছেদ পর্দা নিয়ে ভাইরাল পোস্টের দাবি কি সঠিক?
মে ১৫, ২০২২ ১১:৪২ AM
আঙুল ও কানে রক্তপাত ঘটিয়ে সত্যিই স্ট্রোক প্রতিরোধ সম্ভব?
এপ্রিল ২৮, ২০২২ ০৮:২৮ AM
ডিওডোরান্ট ব্যবহারে স্তন ক্যান্সার হতে পারে!
এপ্রিল ২৭, ২০২২ ০৮:৩১ AM
রোজা নিয়ে গবেষণা করে নোবেল পুরস্কার?
এপ্রিল ২৫, ২০২২ ০৯:২৫ AM