‘রোজা নিয়ে গবেষণা করে জাপানী বিজ্ঞানীর নোবেল পুরস্কার’ শিরোনামে একটি পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। পোস্টে উল্লেখ করা হয়েছে রোজা রাখার উপকারিতা নিয়ে গবেষণা করে জাপানি বিজ্ঞানী ইয়োশিনোরি ওহশোমি ২০১৬ সালে নোবেল পেয়েছিলেন। একজন জাপানি বিজ্ঞানীর রোজা নিয়ে গবেষণার বিষয়টি নেটিজেনদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করলে বিষয়টি নিয়ে অনুসন্ধান চালায় টিম চেক ফ্যাক্ট।
ভাইরাল তথ্যঃ
সম্প্রতি আবু কাউসার সিয়াম নামের এক ফেসবুক আইডি থেকে দেয়া পোস্টে উল্লেখ করা হয়,
‘রোজা ও রমজান Scientific প্রমানিতঃ- রোজা ও রমজান এর উপর গবেষনা করে জাপানী বৈজ্ঞানিক "ইশিনোরী ওসিনী"২০১৬ সালে নোবেল শান্তি পুরস্কার পান।গবেষনায় বলা হয়ঃ-১২ হতে ১৪ ঘন্টা রোজায় দেহে Autography বা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি সহ ক্যান্সার ও ডায়াবেটিস সেল ধ্বংস, বার্ধক্য ও মোটা হওয়া রোধ করে দীর্ঘজীবন দান,ব্রেন-পাকস্হলী-হার্ট-লিভার ও কিডনীর কার্যকারিতা বৃদ্ধি করে..আলহামদুলিল্লাহ,আমীন।‘
এ নিয়ে আরও পোস্ট দেখুন এখানে, এখানে, এখানে এবং এখানে।
তাছাড়া ইউটিউবে ‘রোজা নিয়ে গবেষণা করে নোবেল পুরস্কার জিতলেন জাপানী বিজ্ঞানী !’ শিরোনামে বেশ কিছু ভিডিও রয়েছে।
চেক ফ্যাক্ট অনুসন্ধানঃ
সঠিক তথ্যানুসন্ধানে চেক ফ্যাক্ট গুগল কী-ওয়ার্ড সার্চের সহায়তা নেয়। সার্চে প্রথমেই পাওয়া যায় জাপানের জীববিজ্ঞানী ইয়োশিনোরি ওহশোমির কথা।
২০১৬ সালে জাপানি এই জীববিজ্ঞানীর চিকিৎসা বিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কারের বিষয়টি কী-ওয়ার্ড সার্চের মাধ্যমে নিশ্চিত হওয়া যায়।
তবে ভাইরাল পোস্টে রমজানের রোজার উপর গবেষণা চালিয়ে নোবেল পাওয়ার বিষয়টি উল্লেখ করা হয়। তাই তার গবেষণার বিষয়টি সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে নোবেল কমিটির ওয়েবসাইটে অনুসন্ধান চালানো হয়। যেখানে ইয়োশিনোরি ওহশোমির নিয়ে ০৩ অক্টোবর ২০১৬ তারিখে নোবেল কর্তৃপক্ষ থেকে প্রকাশিত একটি প্রেস বিজ্ঞপ্তি পাওয়া যায়।
যেখানে উল্লেখ করা হয় ,
Yoshinori Ohsumi
for his discoveries of mechanisms for autophagy
Summary
This year’s Nobel Laureate discovered and elucidated mechanisms underlying autophagy, a fundamental process for degrading and recycling cellular components.
এই প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, অটোফ্যাজি পদ্ধতি নিয়ে তার আবিষ্কারের জন্য ওহশোমিকে শরীরতত্ত্ব অথবা মেডিসিন বিভাগে নোবেল পুরষ্কারে ভূষিত করা হচ্ছে। উক্ত বিজ্ঞপ্তিতে অটোফ্যাজি নিয়ে বিস্তর আলোচনাও করা আছে। বিজ্ঞপ্তিটিতে উল্লেখ আছে-
অটোফ্যাজি একটি জৈব রাসায়নিক প্রক্রিয়া। যে প্রক্রিয়ায় দেহের ক্ষয়িষ্ণু এবং অপ্রয়োজনীয় কোষাণুগুলো ধ্বংস ও পরিচ্ছন্ন হয়। আসলে এ হলো কোষের এক আবর্জনা পরিচ্ছন্নকরণ প্রক্রিয়া! কোষের কার্যক্ষমতাকে ঠিক রাখতে যে প্রক্রিয়ার কোনো বিকল্প নেই। আর দেহ যখন বিশেষ সংকটাবস্থায় থাকে, তখন এই অটোফ্যাজিই দেহকে বাঁচিয়ে রাখে!
তাছাড়া প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়,
‘The word autophagy originates from the Greek words auto-, meaning “self”, and phagein, meaning “to eat”. Thus,autophagy denotes “self eating”. This concept emerged during the 1960’s, when researchers first observed that the cell could destroy its own contents by enclosing it in membranes, forming sack-like vesicles that were transported to a recycling compartment, called the lysosome, for degradation. Difficulties in studying the phenomenon meant that little was known until, in a series of brilliant experiments in the early 1990’s, Yoshinori Ohsumi used baker’s yeast to identify genes essential for autophagy. He then went on to elucidate the underlying mechanisms for autophagy in yeast and showed that similar sophisticated machinery is used in our cells.
Ohsumi’s discoveries led to a new paradigm in our understanding of how the cell recycles its content. His discoveries opened the path to understanding the fundamental importance of autophagy in many physiological processes, such as in the adaptation to starvation or response to infection. Mutations in autophagy genes can cause disease, and the autophagic process is involved in several conditions including cancer and neurological disease.’
‘অটোফ্যাজি শব্দটি গ্রীক শব্দ অটো- থেকে এসেছে, যার অর্থ “স্বয়ং”, এবং ফাগেইন, যার অর্থ “খাওয়া”। সুতরাং, অটোফ্যাজি বলতে “নিজেকে খাওয়া” বোঝায়। এই ধারণাটি ৬০ এর দশকে উদ্ভাবিত হয়েছিল, যখন গবেষকরা দেখতে পান শরীরের কোষগুলো নিজেরা নিজেদের বিনাশ করতে পারে, নিজেকে চারপাশ থেকে ঝিল্লিতে আটকে ফেলার মাধ্যমে। এভাবে কোষগুলো বস্তার মতো ফুসকুড়িতে পরিণত হয়, যেটি পরবর্তীতে নবায়নের জন্য কোষের ভেতরে লাইসোসোম নামে একটি রিসাইকেল সেন্টারে স্থানান্তরিত হয়। এর আগে এই বিষয়ে তেমন কিছু জানা ছিলো না। ১৯৯০ এর শুরুর দিকে ইয়োশিনোরি ওহসুমির অনেকগুলো পরীক্ষায়, অটোফ্যাজির জন্য প্রয়োজনীয় জিনগুলো শনাক্ত করতে ইস্ট (Yeast) ব্যবহার করেন। তারপরে তিনি ইস্টে অটোফ্যাজির অন্তর্নিহিত প্রক্রিয়াগুলি ব্যাখ্যা করেন এবং দেখান যে আমাদের কোষগুলোতেও অনুরূপ অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা হয়।
কীভাবে কোষ তার জমানো মালামাল রিসাইকেল করে তা বোঝার ক্ষেত্রে ওহশোমির এই আবিষ্কার নতুন দিগন্তের সূচনা করেছে। অনেক শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়া যেমন উপবাসের সাথে খাপ খাইয়ে নেয়া কিংবা সংক্রমণের প্রতিক্রিয়া ইত্যাদি বোঝার ক্ষেত্রে অটোফ্যাজি দারুণ রাস্তা দেখিয়েছে।
সেখানে আরও উল্লেখ্য,
Autophagy can rapidly provide fuel for energy and building blocks for renewal of cellular components, and is therefore essential for the cellular response to starvation and other types of stress. After infection, autophagy can eliminate invading intracellular bacteria and viruses. Autophagy contributes to embryo development and cell differentiation. Cells also use autophagy to eliminate damaged proteins and organelles, a quality control mechanism that is critical for counteracting the negative consequences of aging.
‘অটোফ্যাজি সেলুলার উপাদানগুলির পুনর্নবীকরণের জন্য শক্তি এবং বিল্ডিং ব্লকগুলির জন্য দ্রুত জ্বালানী সরবরাহ করতে পারে এবং তাই অনাহার এবং অন্যান্য ধরণের চাপের সেলুলার প্রতিক্রিয়ার জন্য অপরিহার্য। সংক্রমণের পরে, অটোফ্যাজি আক্রমণকারী অন্তঃকোষীয় ব্যাকটেরিয়া এবং ভাইরাসকে নির্মূল করতে পারে। অটোফ্যাজি ভ্রূণের বিকাশ এবং কোষের পার্থক্যে অবদান রাখে। কোষগুলো ক্ষতিগ্রস্থ প্রোটিন এবং অর্গানেলগুলোকে নির্মূল করতে অটোফ্যাজি ব্যবহার করে, এটি একটি মান নিয়ন্ত্রণ প্রক্রিয়া যা বার্ধক্যজনিত নেতিবাচক পরিণতিগুলির বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য গুরুত্বপূর্ণ।,
এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক গবেষণা সংস্থা medicinenet How Long Do You Need to Fast for Autophagy? অর্থাৎ ‘অটোফ্যাজির জন্য কতক্ষণ রোজা রাখতে হবে?’ শিরোনামে মার্চ ২২, ২০২১ তারিখে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে
যেখানে উল্লেখ আছে, অটোফ্যাজি হল একটি প্রাকৃতিক সেলুলার প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে আমাদের দেহের কোষগুলো কোষের মধ্যে অপ্রয়োজনীয় বা ক্ষতিগ্রস্থ উপাদানগুলোকে ক্ষয় করে। অটোফ্যাজি প্রক্রিয়া কোষের স্বাভাবিক কার্যকারিতা (হোমিওস্ট্যাসিস) বজায় রাখতে সাহায্য করে। "অটোফ্যাজি" শব্দের আক্ষরিক অর্থ "আত্মভোজন"।
অটোফ্যাজির জন্য কতক্ষণ রোজা রাখতে হবে?
ব্যক্তির বিপাকতন্ত্রের উপর নির্ভর করে, মানুষের মধ্যে অটোফ্যাজিতে দুই থেকে চার দিনের উপবাস লাগে। মূলত গ্লুকোজ এবং ইনসুলিনের মাত্রা উল্লেখযোগ্যভাবে কমে গেলে অটোফ্যাজি শুরু হয় বলে বিশ্বাস করা হয়। প্রাণীজ গবেষণায় ২৪ ঘন্টা উপবাসের পর অটোফ্যাজির প্রমাণ দেখানো হয়েছে, যা উপবাসের প্রায় ৪৮ ঘন্টার মধ্যে শীর্ষে উঠতে শুরু করে। কিছু গবেষণায় ২৪ ঘন্টা পরে মানুষের নিউট্রোফিল (রক্তের সর্বাধিক প্রচুর পরিমাণে ইমিউন কোষ) অটোফ্যাজি সনাক্ত করা হয়েছে।
রোজা সাধারণত ১২ থেকে ১৬ ঘন্টার বেশি রাখা হয় না। আর অটোফ্যাজির কমপক্ষে ২৪ থেকে ৪৮ ঘন্টা সময় লাগে। আর এই গবেষণার কোথাও রোজার কথা উল্লেখ করা হয়নি। সুতরাং, দেখা যাচ্ছে যে জাপানিজ এই বিজ্ঞানী মূলত অটোফ্যাজি নামক একটি প্রক্রিয়ার উপর গবেষণার কারণে নোবেল বিজয়ী হন, রমজানে রোজা রাখার উপর গবেষণা করে নয়।
মূলত অটোফ্যাজি একটি শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়া, উপবাস বা রোজা রাখার মাধ্যমে এটিকে চাঙা করা যায়। কিন্তু উপবাস বা রোজামাত্রই অটোফ্যাজি নয়। তাই টিম চেক ফ্যাক্ট রোজা নিয়ে গবেষণা করে জাপানি বিজ্ঞানীর নোবেল বিজয়ের বিষয়টি বিভ্রান্তিকর বলে চিহ্নিত করছে।
মন্তব্য (0)
দুঃখিত ! কোন মন্তব্য পাওয়া যায়নি