চিকিৎসা ও স্বাস্থ্য

মেয়েদের সতীচ্ছেদ পর্দা নিয়ে ভাইরাল পোস্টের দাবি কি সঠিক?

প্রকাশ: মে ১৫, ২০২২ ১১:৪২ AM

সম্প্রতি মেয়েদের হাইমেন বা সতীচ্ছেদ পর্দা নিয়ে একটি পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপকভাবে ভাইরাল হয়েছে। বিভিন্ন ফেসবুক আইডি ও পেজ থেকে প্রফেসর ডা: রেড্ডির লেখা একটি বহুল প্রচলিত মেডিক্যাল টেক্সট বইয়ের রেফারেন্স দিয়ে বলা হচ্ছে ৯৯ শতাংশ মেয়েদেরই হাইমেন বা সতীচ্ছেদ পর্দা প্রথম যৌনমিলনে ক্ষতিগ্রস্থ হয় বা ছিঁড়ে যায় এবং রক্তপাত হয়। তাছাড়া পোস্টটিতে আরও দাবি করা হয়, সাইকেল চালানো, সাঁতার, আরোহন বা দৌড়ানোর কারণে হাইমেন ছিঁড়ে যাওয়ার কোন সম্ভাবনা নেই। এমন দাবিতে বেশ কয়েকটি ফেসবুক পোস্ট সামনে আসার পর বিষয়টি নিয়ে অনুসন্ধান চালায় টিম চেক ফ্যাক্ট। চলুন দেখে নেয়া যাক অনুসন্ধানে মূলত কি পাওয়া গেল।      

ভাইরাল তথ্যঃ

A K Khan নামের একটি ফেসবুক আইডি থেকে এ বিষয়ে একটি পোস্ট করে লিখা হয়,

আমাদের কিছু মূর্খ ক্ষণিকের মাইয়া ও ঘাউড়্যা ন্যাড়িবাদীদের একটা দাবী হচ্ছে সেক্স ছাড়াও সাইক্লিং,ড্যান্সিং,সুইমিং,ক্লাইম্বিং বা দৌড়াদৌড়ি করলেও হাইমেন(সতীপর্দা) ছিড়ে যায়। কিন্তু মেডিকেল সাইন্সে কোথাও এমন কথা লিখা নাই। উল্টা স্পষ্ট ভাবে বলা আছে এসবের কারণে কখনো হাইমেন ছিড়ে যায় না। ৯৯% হাইমেন ছিড়ে যায় সেক্স এর জন্য। নারীবাদীরা নিজেদের একাধিক জনের শয্যাসঙ্গী হওয়ার পরেও নিজেদের সতী প্রমাণ করতে এই মিথ্যাটাকে একপ্রকার প্রতিষ্ঠিত করে ফেলছে।এমনকি আমাদের স্কুলগুলোর শারীরিক বইতে পর্যন্তও বলা হয়েছে। অনেক ন্যাড়িবাদীই আমার সাথে এই বিষয় নিয়ে অযথাই তর্ক করে তাই পোস্টটা করলাম। নিচে প্রমাণ হিসেবে ফরেনসিক মেডিসিনের অধ্যাপক রেড্ডির বইয়ের ছবি দেওয়া হলো। যে বই পড়ে ভারত,বাংলাদেশ সহ অনেক জায়গায় প্রতি বছর হাজার হাজার ডাক্তার তৈরি হচ্ছে। আশা করি এরপর থেকে এইসব নারীবাদীদের মনগড়া বিজ্ঞানে বিশ্বাস করবেন না।

সুতরাং যদি দেখেন যে, বাসর রাতে রক্তপাত হচ্ছে না তবে বুঝে নিবেন দেশ আগেই স্বাধীন হয়ে গেছে ।

তাছাড়া BUTEX Snakes Society নামের ফেসবুক পেজ থেকেও একই বিষয়ে মে ০৭, ২০২২ তারিখে একটি পোস্ট করা হয়।  

চেক ফ্যাক্ট অনুসন্ধান

অনুসন্ধানের শুরুতেই মেয়েদের হাইমেন মূলত কি কারণে ক্ষতিগ্রস্থ হতে পারে বা ছিঁড়ে যেতে পারে তা দেখতে গুগলে কী-ওয়ার্ড সার্চ করা হয়। কী-ওয়ার্ড সার্চে এ সম্পর্কিত বেশকিছু ওয়েবসাইটের লিংক সামনে আসে। 

শুরুতেই ইংল্যান্ডের ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিসের ওয়েবসাইটে প্রবেশ করলে দেখা যায় যৌন মিলন ছাড়াও হাইমেন ক্ষতিগ্রস্থ হওয়ার বেশকিছু কারণ যেমন ঘোড়ায় চড়া, ট্যাম্পনের ব্যবহার ও হস্তমৈথুন কথা সেখানে উল্লেখ করা আছে।

তাছাড়া গুগল কী-ওয়ার্ড সার্চে আমেরিকার সেলফ ম্যাগজিনের একটি লিংকও সামনে আসে। সেখানেও যৌন মিলন ছাড়া বাইক চালানো, ঘোড়ায় চড়া, জিমন্যাস্টিকস এমনকি হস্তমৈথুনের কারণে হাইমেন ছিড়ে যেতে পাড়ে বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

তাছাড়া ইংল্যান্ডের ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিসের ওয়েবসাইটের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে প্রথম যৌন মিলনে সব সময় রক্তপাত হবে এই ধারণা ঠিক নয়। প্রতিবেদনটিতে উল্লেখ করা হয়েছে,

No, not always. Some women will bleed after having sex for the first time, while others will not. Both are perfectly normal. A woman may bleed when she has penetrative sex for the first time because of her hymen stretching or tearing. The hymen is a thin piece of skin that partially covers the entrance to the vagina. For some women, it may stretch or tear when they start having sex.

অর্থাৎ প্রথমবার সহবাস করার পরে কিছু মহিলার রক্তপাত হবে, অন্যদের তা নাও হতে পারে এবং দুটোই পুরোপুরি স্বাভাবিক। একজন মহিলার হাইমেন প্রসারিত বা ছিঁড়ে যাওয়ার কারণে প্রথমবার সহবাসের সময় রক্তপাত হতে পারে।

তাছাড়া "Differences in Hymenal Morphology Between Adolescent Girls with and Without a History of Consensual Sexual Intercourse", সম্মতিমূলক যৌন মিলন করেছে এবং করেনি এমন কিশোরী মেয়েদের মধ্যে হাইমেনাল আকারের পার্থক্য শিরোনামে একটি গবেষণায় দেখা যায় পূর্বে সহবাস করেছে এমন ৫২ শতাংশ কিশোরীর হাইমেন বা সতীচ্ছদ পর্দায় কোন স্পষ্ট পরিবর্তন দেখা যায় নি।

এছাড়া The Ohio State University এর মেডিসিনের প্রফেসর Jonathan Schaffir ফেব্রুয়ারি ২০, ২০২০ তারিখে প্রকাশিত The Hymens Tale: Myths and facts about the hymen অর্থাৎ দ্য হাইমেনস টেল: হাইমেন সম্পর্কে মিথ এবং তথ্য শিরোনামের একটি প্রতিবেদনে লিখেছেন, কোনো নারীর “কুমারীত্ব” তার হাইমেনের উপর নির্ভর করে না। তাই কোনো নারীকে পরীক্ষা করে এটা জানা অসম্ভব যে সে কুমারী কি না। অর্থ্যাৎ, শুধুমাত্র যৌন মিলন ছাড়াও আরো অন্যান্য কারণে হাইমেন প্রসারিত কিংবা ছিঁড়তে পারে। তাই হাইমেনের উপর ভিত্তি করে কারো যৌন মিলনের অভিজ্ঞতা ছিলো কি না তা বলা সম্ভব না।

এছাড়া ভাইরাল হওয়া পোস্টের সাথে যে বইয়ের ছবিগুলো জুড়ে দেয়া হয়েছে, তার নাম “দি এসেন্সিয়ালস অব ফরেনসিক মেডিসিন এন্ড টক্সিকোলজি (The Essentials of Forensic Medicine and Toxicology)”এই বইয়ের লেখক ডা: কে. এস নারায়ণ রেড্ডি (Dr. K. S. Narayan Reddy) এবং ডাঃ ও. পি মূর্তি (Dr. O. P. Murthy)। বইটিতে ফরেনসিক সাইন্সের নানা দিক নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে।   

বইটিতে ৯৯ শতাংশ মেয়েদেরই হাইমেন বা সতীচ্ছেদ পর্দা প্রথম যৌনমিলনে ক্ষতিগ্রস্থ হয় বা ছিঁড়ে যায় এবং সাইকেল চালানো, সাঁতার, আরোহন বা দৌড়ানোর কারণে হাইমেন ছিঁড়ে যাওয়ার কোন সম্ভাবনা নেই বলে উল্লেখ আছে বলে দেখা যায়।

মূলত বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ওয়েবসাইট থেকে ২০১৮ সালে প্রকাশিত Eliminating virginity testing An interagency statement শিরোনামে একটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ভার্জিনিটি পরীক্ষা এখনো অনেক মেডিক্যাল অনুশীলন কিংবা বইয়ে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে তবে তা শুধুমাত্র ধর্ষণ চিহ্নিত করার জন্য প্রয়োগ করা হয়ে থাকে। প্রতিবেদনটির রেফারেন্স অংশে ৭৭ নাম্বারে ডা: রেড্ডির এই বইয়ের নামও উল্লেখ আছে।  

অর্থাৎ এখানে অপরাধ বিজ্ঞানের উপর ভিত্তি করে প্রকাশিত বইয়ের সাথে স্বাভাবিক অবস্থাকে ভুলভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। একইসাথে অর্ধেক তথ্য দেয়ার ফলে এক ধরনের বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়েছে।

এছাড়া যৌন মিলনের কারণে ৯৯% হাইমেন ছিঁড়ে যায় এই দাবির পিছনে কোনো তথ্যসূত্র প্রদান করা হয়নি। এমন দাবির পেছনে যৌক্তিক কোনো প্রমানও খুঁজে পাওয়া যায়নি। তাছাড়া উপরোক্ত বইয়ের একই অধ্যায়ের ৩৯২ পৃষ্ঠাতে বলা হয়েছে, এমনও দেখা যায় যে, প্রতিনিয়ত যৌন সঙ্গমের পরেও কারও হাইমেনের কোনো পরিবর্তন হয়নি। অর্থ্যাৎ, যেখানে বলা হচ্ছে প্রতিনিয়ত যৌন মিলনের পরেও হাইমেন অপরিবর্তিত থাকতে পারে। সেক্ষেত্রে এককভাবে হাইমেন ছিঁড়ে যাওয়ার পিছনে যৌন মিলনকে দায়ী করা  ভিত্তিহীন। 

তাছাড়া সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব ডা: তাসনিম জারা সম্প্রতি কুমারীত্ব পরীক্ষা বা ভার্জিনিটি টেস্টিং: সর্বশেষ নির্ভরযোগ্য তথ্য শিরোনামে তার ভেরিফাইড ফেসবুক পেজ থেকে একটি ভিডিও পোস্ট করেন। সেখানে তিনি বলেন, “সহবাস ছাড়াও বিভিন্ন কারণে হাইমেন টান পড়তে পারে বা ছিড়ে যেতে পারে; যেমন, খেলাধুলা, আঘাত পাওয়া, মাসিকের সময় টেমপন ব্যবহার করা ইত্যাদি। তাই হাইমেন দেখে নিশ্চিত ভাবে বলা সম্ভব না যে সে পুর্বে সহবাস করেছে কি না।”

সুতরাং উপরোক্ত তথ্য উপাত্তের ভিত্তিতে এ বিষয়টি স্পষ্ট যে, ৯৯ শতাংশ মেয়েদেরই হাইমেন বা সতীচ্ছেদ পর্দা প্রথম যৌনমিলনে ক্ষতিগ্রস্থ হয় বা ছিঁড়ে যায় এবং রক্তপাত হয় বলে যে দাবি বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে করা হয়েছে তা সত্য নয়। তাছাড়া সাইকেল চালানো, সাঁতার, আরোহন বা দৌড়ানোর কারণে হাইমেন ছিঁড়ে যাওয়ার কোন সম্ভাবনা নেই বলে যে দাবিটি করা হয়েছে, তারও কোন ভিত্তি নেই।

তাই আগে সত্য জানুন, তারপর প্রচার করুন। 

মন্তব্য (0)


দুঃখিত ! কোন মন্তব্য পাওয়া যায়নি

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন

সত্যিই কী লেবুর রস মিশ্রিত গরম পানি সেবনে ক্যান্সার নিরাময় হয়?
সেপ্টেম্বর ০৫, ২০২২ ০৫:০২ PM
ঋতুস্রাবকালীন কিছু খাবার এবং নিয়ম মেনে চলা নিয়ে ফেসবুকে ভাইরাল পোস্টের দাবিগুলো মিথ্যা
জুলাই ২০, ২০২২ ০৮:৩১ AM
মাংকিপক্সঃ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের গুজব
মে ৩১, ২০২২ ০৮:১২ AM
চট্টগ্রামে একসাথে সাত সন্তান জন্মদানের দাবিটি সত্য নয়
মে ২৯, ২০২২ ০৮:১৪ AM
আঙুল ও কানে রক্তপাত ঘটিয়ে সত্যিই স্ট্রোক প্রতিরোধ সম্ভব?
এপ্রিল ২৮, ২০২২ ০৮:২৮ AM
আঙুল ও কানে রক্তপাত ঘটিয়ে সত্যিই স্ট্রোক প্রতিরোধ সম্ভব?
এপ্রিল ২৮, ২০২২ ০৮:২৮ AM
ডিওডোরান্ট ব্যবহারে স্তন ক্যান্সার হতে পারে!
এপ্রিল ২৭, ২০২২ ০৮:৩১ AM
রোজা নিয়ে গবেষণা করে নোবেল পুরস্কার?
এপ্রিল ২৫, ২০২২ ০৯:২৫ AM