গত ৩০ জুন, ২০২২ তারিখে জাতীয় পার্টির এমপি ফখরুল ইমাম সংসদে দেয়া তার এক দীর্ঘ ভাষণে বাংলাদেশের বিভিন্ন শ্রেণীর পাঠ্যপুস্তকে কিছু পরিবর্তন আনা হয়েছে বলে দাবি করেন। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পাঠ্য বইয়ের বিভিন্ন বিষয়ে ইসলাম ধর্ম সম্পর্কিত তথ্য বাদ দিয়ে হিন্দু ধর্ম সম্পর্কিত তথ্যকে প্রাধান্য দিয়ে সংস্কৃতি বদলের চেষ্টা করা হচ্ছে বলে অভিযোগ তোলেন তিনি। বিষয়টির সত্যতা নিয়ে বিস্তারিত অনুসন্ধান চালায় টিম চেক ফ্যাক্ট।
ফখরুল ইমামের বক্তব্যঃ
ময়মনসিংহ-৮ আসনের সংসদ সদস্য ফখরুল ইমাম জাতীয় সংসদে ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের অর্থ বরাদ্দের প্রস্তাবের ছাঁটাইয়ের আলোচনায় অংশ নিয়ে তিনি বলেন,
বর্তমানে যে শিক্ষাব্যবস্থা প্রাইমারিতে আছে সেখানে ‘সবাই মিলে কাজ করি’ শিরোনামে মহানবীর সংক্ষিপ্ত জীবনী ছিল সেটা বাদ দিয়েছে। তৃতীয় শ্রেণিতে খলিফা হযরত আবু বকর শিরোনামে একটা সংক্ষিপ্ত জীবনী সেটা বাদ দিয়েছে। চতুর্থ শ্রেণিতে হযরত ওমর শিরোনামে একটা সংক্ষিপ্ত জীবনী বাদ দেওয়া হয়েছে। পঞ্চম শ্রেণিতে একটা বিদায় হজ নামে মহানবীর জীবনী ছিল সেটা বাদ দেওয়া হয়েছে।
এছাড়া পঞ্চম শ্রেণিতে ‘বই’ নামে একটা কবিতা অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে যেটা ধর্মীয়গ্রন্থ কোরআন বিরোধী কবিতা। এছাড়া ষষ্ঠ শ্রেণিতে ‘লাল গরু’ নামে একটি ছোট গল্প আনা হয়েছে যেখানে মুসলিম শিক্ষার্থীকে শেখানো হচ্ছে গরু হচ্ছে মায়ের মতো, তাই জবাই করা ঠিক নয়। অর্থাৎ হিন্দুত্ববাদ।
তিনি আরও বলেন, সপ্তম শ্রেণিতে শরৎচন্দ্র চট্টপাধ্যায়ের ‘লালু’ নামক একটা গল্প অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে যাতে শেখানো হচ্ছে হিন্দুদের কালী পুজা ও পাঠা বলীর কাহিনী। এগুলো কীসের আলামত? আমরা সবাই একসঙ্গে থাকতে চাই। একটা সংস্কৃতি বাদ দিয়ে অন্য একটা সংস্কৃতিকে গুরুত্ব দিবেন সেটা কিন্তু শিক্ষামন্ত্রণালয়কে দেখতে হবে।
স্কুলের পাঠ্যবইয়ে পরিবর্তনগুলোকে ‘হিন্দুত্ববাদ’ বললেন এমপি ফখরুল ইমাম (ভিডিও) শিরোনামে জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য ফখরুল ইমামের বক্ত্যব্যের ভিডিওটি চ্যানেল ২৪ এর ভেরিফাইড ইউটিউব চ্যানেলে জুন ৩০, ২০২২ তারিখে আপলোড করা হয়।
এবিষয়ে জাতীয় দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনগুলো দেখুন এখানে, এখানে ও এখানে।
চেক ফ্যাক্ট অনুসন্ধানঃ
অনুসন্ধানের শুরুতেই অভিযোগগুলো খতিয়ে দেখার জন্য ২০২২ শিক্ষাবর্ষের ন্যাশনাল কারিকুলাম এন্ড টেক্সট বুক (এনসিটিবি) এর ওয়েবসাইট থেকে তৃতীয় শ্রেণি, চতুর্থ শ্রেণি, পঞ্চম শ্রেণি, ষষ্ঠ শ্রেণি ও সপ্তম শ্রেণির বাংলা বই ডাউনলোড করা হয়। প্রথমে পঞ্চম শ্রেণির বাংলা বই থেকে বিদায় হজ্ব গল্পটা বাদ দেওয়া হয়েছে বলে যে অভিযোগটি করা হয় তার উপর অনুসন্ধান চালানো হয়। পাঠ্য বইয়ের সূচি পর্যালোচনা করে দেখা যায়, প্রাথমিক স্তরে অন্তর্ভূক্ত পঞ্চম শ্রেণীর বইয়ের ৯৫ নম্বর পৃষ্ঠায় বিদায় হজ্বের গল্পটা হুবহু রয়েছে।
২০২২ শিক্ষাবর্ষের পঞ্চম শ্রেণীর বইয়ের পিডিএফ কপিটি দেখতে পারেন এখানে।
দ্বিতীয় অভিযোগটি করা হয় ৩য় শ্রেণির বাংলা বইতে হযরত আবু বকর (রা) এর জীবনী বাদ দেওয়া বিষয়ে। এবিষয়ে ২০২২ শিক্ষাবর্ষের ন্যাশনাল কারিকুলাম এন্ড টেক্সট বুক এর ওয়েবসাইটে ৩য় শ্রেণির বাংলা বইতে অনুসন্ধান চালালে দেখা যায়, সেই বইয়ের ৯৯ নম্বর পৃষ্ঠায় হযরত আবু বকর (রা) এর জীবনী গল্পটা রয়েছে।
২০২২ শিক্ষাবর্ষের ৩য় শ্রেণীর বইয়ের পিডিএফটি দেখতে পারেন এখানে।
বক্তব্যে ৩য় অভিযোগটি করা হয়, ৪র্থ শ্রেণিতে বাংলা হযরত ওমর (রাঃ) এর জীবনী বাদ দেওয়া হয়েছে। এবিষয়ে ২০২২ শিক্ষাবর্ষের ন্যাশনাল কারিকুলাম এন্ড টেক্সট বুক এর ওয়েবসাইটে ৪র্থ শ্রেণীর বাংলা বইতে অনুসন্ধান চালালে দেখা যায়, সেই বইয়ের ৯৭ নম্বর পৃষ্ঠায় হযরত ওমর (রাঃ) এর জীবনী গল্পটা হুবহু আছে।
২০২২ শিক্ষাবর্ষের ৪র্থ শ্রেণির বইয়ের পিডিএফ কপিটি দেখতে পারেন এখানে।
তার চতুর্থ অভিযোগটি ছিলো, পঞ্চম শ্রেণির বাংলা বিষয়ে 'বই' নামে একটা কবিতা অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে যেটা কোরান বিরোধী কবিতা। অনুসন্ধান চালিয়ে দেখা গেছে পঞ্চম শ্রেণীর বাংলা এই বিষয়ে কোন কবিতার অস্তিত্ব নেই।
২০২২ শিক্ষাবর্ষের পঞ্চম শ্রেণির বইয়ের পিডিএফ কপিটি দেখতে পারেন এখানে।
পঞ্চম অভিযোগে তিনি বলেন, ষষ্ঠ শ্রেণির বাংলা বইতে 'লালগরু' নামে একটি গল্প যুক্ত করা হয়েছে যেখানে বলা হয়েছে গরু মায়ের মত,তাই জবাই করা উচিত না। অনুসন্ধানে দেখা গেছে ষষ্ঠ শ্রেণির বাংলা বইয়ে এই বিষয়ে কোন গল্পের অস্তিত্ব নেই।
২০২২ শিক্ষাবর্ষের পঞ্চম শ্রেণীর বইয়ের পিডিএফ দেখতে পারেন এখানে।
সর্বশেষ অভিযোগটি ছিলো, সপ্তম শ্রেণির আনন্দ পাঠ (বাংলা দ্রুত পঠন) বইয়ে শরৎচন্দ্র চট্টপাধ্যায়ের ‘লালু’ নামের একটি গল্প যুক্ত করা হয়েছে যেখানে কালী পূজা এবং বলির গল্প রয়েছে। অনুসন্ধান চালিয়ে দেখা গেছে, সপ্তম শ্রেণির বাংলা বইয়ে এই বিষয়ে কোন গল্পের অস্তিত্ব নেই।
২০২২ শিক্ষাবর্ষের সপ্তম শ্রেণির বাংলা বইয়ের পিডিএফ দেখতে পারেন এখানে।
সকল তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ফখরুল ইমাম পাঠ্যবই থেকে যে বিষয়গুলো বাদ দেওয়া হয়েছে বলে দাবি করেছেন, সেই বিষয়গুলো বইতে আছে। আর যেসব বিষয় নতুন করে যুক্ত করা হয়েছে বলে দাবি করেছেন, সেই বিষয়গুলোর অস্তিত্ব পাঠ্যবইয়ে নেই।
প্রসঙ্গত, কয়েক বছর পরপরই বাংলাদেশের পাঠ্যবইয়ে কিছু পরিবর্তন আনা হয়। এমপি ফখরুল যে পরিবর্তনের কথা বলেছেন, মূলত পাঠ্যবইয়ে এই পরিবর্তনগুলো আনা হয়েছিল ২০১৭ সালে। এবিষয়ে ১০ মার্চ, ২০১৭ সালের বিবিসির প্রতিবেদনে বিস্তারিত উল্লেখ আছে।
সুতরাং উপরোক্ত তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, পাঠ্যবইয়ের বিভিন্ন বিষয়ে একটা ইসলাম সম্পর্কিত তথ্য বাদ দিয়ে হিন্দু ধর্মকে প্রাধান্য দিয়ে সংস্কৃতি বদলের চেষ্টা করা হচ্ছে বলে ফখরুল ইমামের অভিযোগটি সম্পূর্ন মিথ্যা।
মন্তব্য (0)
দুঃখিত ! কোন মন্তব্য পাওয়া যায়নি